আজকের দিনে বাঙালিদের প্রধানতঃ দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গ , বাংলাদেশে এবং ত্রিপুরা । কিন্তু এর বাইরে, আসামের কাছাড় , হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ , গোয়ালপাড়া ও ধুবড়ি; মেঘালয়ের কিছু এলাকায়, ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ, সিংভূমও , সাঁওতাল পরগনা অঞ্চলে, বিহারের পূর্ণিয়া, ওড়িশার বালাশোর ও কটকেও অনেক বাঙালি বাস করেন। তাই আমি বাংলা বলতে সব বাংলাভাষী লোকেদের কথাই বলছি।
রাজা শশাঙ্কের
আগে বাংলা অনেক ভাগে বিভক্ত ছিল। যেমনঃ পুন্ড্র, বঙ্গ , সমতট , হরিকেল, ইত্যাদি ।
তাই এই আলোচনাটা শশাঙ্কের পর থেকেই শুরু
করা যাক।
শশাঙ্কের
রাজধান ছিল কর্ণসুবর্ণ। আজকের দিনের মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের রাঙামাটির কাছে। শাসনকাল ছিল ৫৯০ থেকে ৬২৫ সাল পর্যন্ত। ।
খর্গ
রাজবংশ বঙ্গ ও সমতট অঞ্চলে
রাজত্ব করেছিলেন ৬২৫ থেকে ৭০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। রাজধানী ছিল বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার বড়কামতায় ।
৭৫০
সালে গোপাল পালবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। যা চলে চারশ
বছর ধরে। কারুর মতে পাল রাজাদের রাজধানী ছিল মুদ্গগিরি , এখানকার দিনের বিহারের মুঙ্গের কাছে।
একটা
সময়ে পাটলিপুত্র ছিল পাল রাজাদের রাজধানী। এই শহরটা ছিল
আজকের দিনের পাটনার কাছাকাছি।
আবার
অন্যমতে, পাল রাজাদের রাজধানী ছিল সম্ভবতঃ বলিরাজগড়, আজকের বিহারের মধুবনী জেলায়।
অনেকে
মনে করেন, দেবপালের রাজধানী ছিল সোমপুর, বাংলাদেশের পাহাড়পুরের কাছে, নোয়াগাঁও জেলায়।
অনেকে
আবার মনে করেন যে মহিপালের রাজধানী
ছিল মুর্শিদাবাদে।
রামপালের
রাজধানী ছিল রামাবতী , এটাও অনেকে মনে করেন। এই জায়গাটা ছিল
বরেন্দ্র ভূমি অঞ্চলে।
এর
পর আসে সেন রাজবংশ। ১০৭০ সাল থেকে ১২৩০ সাল পর্যন্ত এনারা রাজত্ব করেছিলেন।
বিজয়সেন
এর রাজধানী ছিল বিজয়পুরী এবং পরবর্তীকালে বিক্রমপুর, আজকের বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলায়।
অনেকের
মতে বল্লালসেনের সময়ে রাজধানী ছিল নবদ্বীপ। সেন রাজারা পরবর্তীকালে আবার বিক্রমপুরে চলে এসেছিলেন।
ধানুজ
রাই , সম্ভবতঃ শেষ হিন্দু রাজা, ১২৮০ সালে রাজধানী সুবর্ণগ্রাম এ স্থানান্তরিত করেন।
পরবর্তীকালে এই শহরের নামকরণ
হয় সোনারগাঁও।
সেনবংশের
পরে কিছু সময়ের জন্য বাংলার শাসক ছিলেন দেব বংশ। ওনাদের সময় রাজধানী ছিল মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুর ।
এর
পর ১২০৪ থেকে ১২৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলা দিল্লি হতে মুসলিম শাসকদের অধীনে শাসিত হতো
। খিলজি, মামলুক
তখন দিল্লির সুলতান। এই সময়ে বাংলার
রাজধানী ছিল মালদা জেলার গৌড়।
১২৮৭
থেকে ১৩২৪ সাল পর্যন্ত বলবন বংশ বাংলা শাসন করেছিলেন। ওই সময়ে রাজধানী
ছিল মালদা জেলার পান্ডুয়া । পান্ডুয়া শহরের
তখন নাম ছিল ফিরোজাবাদ।
এরপর
বাংলা দিল্লির তুঘলক শাসনে চলে আসে ১৩২৪ থেকে ১৩৩৯ সাল পর্যন্ত। এরপর বাংলায় স্বাধীন সুলতানদের শাসন শুরু হয়। তা চলে ১৫৭৪
সাল পর্যন্ত।
তারপর
বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে যায়।
এই
দীর্ঘ সময়ে একাধিক রাজবংশ চলেছে। ইলিয়াস শাহী , রাজা গনেশ, হুসেন শাহ, ইত্যাদি। ইলিয়াস শাহীর সময়ে রাজধানী ছিল পান্ডুয়া (ফিরোজাবাদ)। পান্ডুয়া রাজধানী
ছিল ১৩৫২ থেকে ১৪৫০ সাল পর্যন্ত।
পরে
রাজধানী হয় গৌড় (লক্ষণাবতী
)।
তখন
১৪৫০ সাল। কররানী বংশ সম্ভবতঃ বাংলার শেষ সুলতানি শাসন। সুলতান সুলেমান খান কররানী ১৫৬৫ সালে রাজধানী টান্ডা (মালদহের কাছে ) তে সরিয়ে নেন।
পরে রাজধানী গৌড় ফিরিয়ে আনা হয়।
মুঘল
আমলে রাজধানী ছিল রাজমহল। ওই জায়গাটা ছিল
আজকের ঝাড়খণ্ডের দুমকা শহরের কাছে।
ঢাকা
রাজধানী ছিল ১৬০৮ থেকে ১৬৩৯ পর্যন্ত। ১৬১০ সালে ঢাকার নাম পরিবর্তন করে অবশ্য জাহাঙ্গীর নগর করা হয়েছিল।
দ্বিতীয়
দফায় রাজমহল আবার রাজধানী ছিল ১৬৩৯ থেকে ১৬৬০ পর্যন্ত। রাজধানী আবার ঢাকাতে ফিরিয়ে আনা হয় ১৬৬০ সালে
। ১৭০৪ পর্যন্ত ঢাকাই ছিল আমাদের রাজধানী।
মুর্শিদাবাদ
রাজধানী ছিল ১৭০৪ থেকে ।
মুঘল
রাজবংশ দুর্বল হওয়ার সুযোগে বাংলায় আবার স্বাধীন নবাবদের রাজত্ব শুরু হয়। এর শুরু ১৭১৭
সাল থেকে। মুর্শিদকুলি খান প্রথম নবাব। সিরাজ-উদ-দৌলা ছিলেন
শেষ নবাব।
এর
পর ধীরে ধীরে ব্রিটিশ শাসন শুরু হল। রাজধানীও কলকাতাতে স্থানান্তরিত হয়। তখন ১৭৯০ সাল।
আরো
কিছু রাজবংশের উল্লেখ করা উচিত।
মল্ল
রাজারা বাঁকুড়া, বর্ধমান, বীরভূম, সাঁওতাল পরগনা , মেদিনীপুর ও পুরুলিয়া অঞ্চলে
অনেকদিন রাজত্ব করেছিলেন। ৬৯৪ সাল থেকে ব্রিটিশদের সময় পর্যন্ত। ওনাদের রাজধানী ছিল বিষ্ণুপুর।
চন্দ্র
রাজবংশ ৯০০ থেকে ১০৫০ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। ওনারা হরিকেল অঞ্চলের। ওনাদের রাজধানী ছিল সম্ভবতঃ কুমিল্লা জেলার দেবপর্বত এলাকায়।
ভুরশুট
, আজকের দিনের হাওড়া ও হুগলী অঞ্চলে,
এক রাজবংশ অনেকদিন রাজত্ব করেছিলে। ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে।
এছাড়াও
চন্দ্রদ্বীপের মহারাজা, কোচবিহারের মহারাজা, যশোরের মহারাজা, মেদিনীপুরের মহারাজা এবং নদিয়ার মহারাজারা নিজ নিজ রাজ্যপাট বজায় রেখেছিলেন।
সুতরাং,
রাজধানীর একটা সময়সারণি এই রকম বলা
যেতে পারে।
কর্ণসুবর্ণ
(৫৯০ – ৬২৫)
গৌড়
(৭৫০ - ৭৭০)
পাটলিপুত্র
(৭৭০ - ১০৯৭)
বিক্রমপুর
(১০৯৭-১২০৫)
গৌড়
(লক্ষণাবতী) (১২০৫ - ১৩২৫)
সোনারগাঁ,
গৌড় , সাতগাঁ (১৩২৫ -১৩৫২ )
পান্ডুয়া
(১৩৫২ – ১৪৫০ )
গৌড়
(১৪৫০ – ১৫৬৫ )
টান্ডা
(১৫৬৫ - ১৫৭৪)
গৌড়
(১৫৭৪ - ১৫৭৫)
টান্ডা
(১৫৭৫ - ১৫৯৪)
রাজমহল
(১৫৯4 – ১৬০৮ )
ঢাকা
(১৬০৮ – ১৬৩৯)
রাজমহল
(১৬৩৯ – ১৬৬০)
ঢাকা
(১৬৬০ – ১৭০৪)
মুর্শিদাবাদ
(১৭০৪ - ১৭৯০)
বাংলার
নদীগুলি বারবার পথ পরিবর্তন করেছে।
তাই ওই সময়কার সঠিক
অবস্থান আজকের দিনের মানচিত্রে দেয়া কঠিন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে অনেক লেখাতে
লক্ষণাবতী র অবস্থান গঙ্গা নদীর
পশ্চিম তীরে বলা আছে। কিন্তু, লক্ষণাবতী আর গৌড় একই
শহর। কিন্তু আজকের দিনে গৌড় গঙ্গানদীর পূর্ব তীরে।
উৎসঃ
0 comments: