আজকে তো বর্ণপরিচয় বা সহজপাঠ দিয়ে বাঙালি শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। কিন্তু প্রাচীন যুগে কেমন ছিল বাঙালির শিশুশিক্ষাব্যবস্থা? সেযুগের বাঙালি শিশুর হাতেখড়ি হত কোন পুস্তকে?
প্রাচীন বাঙালির শিশুশিক্ষার এই বিবরণ পাওয়া যায় ই সিং (I Tsing) এর বর্ণনা থেকে। তা অনেকটা এমনঃ
মাৎস্যন্যায় যুগে এবং তার অনেক পরে পালযুগ পর্যন্তও বাঙালির শিশুশিক্ষার হাতেখড়ি ও প্রথম পাঠ যে বইটি দিয়ে হত, তার নাম ছিল সিদ্ধিরত্থু।
এটি প্রাকৃত নাম, এটিই প্রচলিত নাম ছিল। তবে সংস্কৃতে কথাটা সিদ্ধিরস্তু (সিদ্ধি হোক, এই অর্থ)। এই আশীর্বাণী দিয়ে বইটির শুরু বলে এরকম নাম। প্রসঙ্গত এই সিদ্ধিরস্তু একটি শর্টহ্যান্ড চিহ্নের দ্বারা প্রকাশিত হত। ৭৺ অর্থাৎ বাংলা সংখ্যা সাতের মাথায় একটা চন্দ্রবিন্দু। এই শর্টহ্যান্ডকে আঁজি চিহ্ন নামেও ডাকা হয়। আমার মনে হয়েছে এটাই পরবর্তীকালে চিঠির মাথায় সাড়ে চুয়াত্তরে পরিণত হয়েছিল মধ্য ও আধুনিক যুগে।
ছয় বছর বয়সে সেযুগের বাঙালি শিশুর পাঠ শুরু হত এই সিদ্ধিরত্থু দিয়ে, এবং এ বইটি সাধারণত ছয় মাসে শেষ করতে হত।
সিদ্ধাচার্য সরহ তাঁর একটি দোহায় উল্লেখ করেছেন এই সিদ্ধিরত্থু গ্রন্থের কথা। সেটি বেশ মজাদার, উদ্ধৃত করছি।
সিদ্ধিরত্থু মই পঢমে পঢিঅউ
মণ্ড পিঅন্তেঁ বিসরিঅ এমউ।
এর মানে হল প্রথম বয়সে আমিও সিদ্ধিরত্থু পড়েছিলাম, পরে মণ্ড খেতে খেতে এমনিই সব ভুলে মেরে দিয়েছি।
এই সিদ্ধিরত্থুতে মোট উনপঞ্চাশ বর্ণের উপদেশ ছিল বলে জানা যাচ্ছে। অর্থাৎ ওই যে আজকে আমাদের অয়ে অজগর আসছে তেড়ে, আমটি আমি খাব পেড়ে, ওরকমই এক একটি বর্ণ ধরে ধরে বাক্য, কিন্তু সেগুলি ছেলে ভুলোনো ছড়া নয় কেবল, সেগুলি উপদেশাত্মক ছিল।
ছয় মাসে সিদ্ধিরত্থু শেষ করার পরই শিশু ছুটি পেত, বেশ আরামদায়ক দীর্ঘ ছুটি (বোধকরি এই ছুটির সময়েই সরহর মণ্ড খেতে খেতে সব পড়া ভুলে যাওয়ার সূত্রপাত)।
এরপর আট বছর বয়সে পা দিলেই (অর্থাৎ সাত বছর পূর্ণ হলেই) আবার পড়া শুরু। এবার ব্যকরণ সূত্র, এবং এটি কণ্ঠস্থ করতে আট মাস সময় পেত বাচ্চারা। তারপর শব্দবিদ্যা শেখানো হত। শব্দরূপ ধাতুরূপ দিয়ে শুরু, শেষে উচ্চতর পাঠ।
তেরো বছরের মধ্যেই ভাষা ও ব্যকরণচর্চা শেষ (খুব সম্ভবত একটি ধাপ শেষ করলেই পরের ধাপের আগে ছুটি পাওনা হত)। এইবার নিজের কুলবৃত্তি অনুযায়ী বা নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী বিশেষ বিদ্যার চর্চা শুরু হবে। দেখা যাচ্ছে ছয় থেকে তেরো, এই ছয়-সাত বছর নির্দিষ্ট ছিল বাঙালি শিশুর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য।
এবং এই ধরণের বিস্তারিত শিক্ষাব্যবস্থা যে সেই মাৎস্যন্যায় যুগেও ধরে রেখেছিল বাঙালি, তা থেকে প্রমাণ হয়, এ জাতি দুর্দশায় পতিত হলেও শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রাণপণে রক্ষা করতে চেষ্টা করে।
প্রাচীন বাঙালির শিশুশিক্ষার এই বিবরণ পাওয়া যায় ই সিং (I Tsing) এর বর্ণনা থেকে। এই চিনদেশীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু ৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে তাম্রলিপ্ত এসেছিলেন, এবং নালন্দায় দশ বছর কাটান। এরপর তাম্রলিপ্ত থেকেই ৬৮৫ খ্রিস্টাব্দে সমুদ্রযাত্রা করেন দেশে ফেরার জন্য। সেন যুগের রাঢ়বঙ্গে শিশুশিক্ষার একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছিলেন ই সিং।
বারেন্দ্রভূমে প্রথম পালসম্রাট গোপালের পিতামহ দয়িতবিষ্ণুর হাতেখড়ি কিভাবে হয়েছিল, আপনি এখন জানেন
© তমাল দাশগুপ্ত
মূল পোস্ট ২২শে জুন ২০১৯, সামান্য পরিবর্ধিত।
0 comments: