সেনযুগের রণদেবতা ছিলেন উগ্রমাধব। তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিয়েই সেনযোদ্ধাগণ প্রয়াগ থেকে কামরূপ, চেদি থেকে উৎকল পর্যন্ত ভূভাগে বাঙালির সাম্রাজ্য প্রসারিত করেছিলেন। সেননৃপতি লক্ষ্মণসেনের সভার জয়ধ্বনি ছিল "রাধামাধবোর্জয়ন্তি"। অর্থাত্ সভার মননশীল পরিবেশে রাধামাধব এবং যুদ্ধের উগ্র পরিবেশে উগ্রমাধব ছিলেন সেনযুগের বাঙালির আদর্শ।
উগ্রমাধবের মূর্তি কেমন ছিল তা নিয়ে অনেক
তত্ত্ব আছে। এটুকু বোঝা যায় এই মূর্তি বিষ্ণুর
উগ্ররসের বিগ্রহ। লক্ষ্মণসেনের খাড়ি তাম্রশাসনে উগ্রমাধব মূর্তি প্রতিষ্ঠার বিবরণ পাওয়া যায় এবং সেখানেই লক্ষ্মণসেন পরমনারসিংহ উপাধিতে অভিহিত হয়েছেন। সুতরাং উগ্রমাধব মূর্তি কোনোভাবে নৃসিংহ মূর্তির সাথে সংযুক্ত। কিন্তু শুধুই কি নৃসিংহ মূর্তি?
তাহলে এই বিশিষ্ট নামটি
দেওয়া কেন?
এই প্রসঙ্গে বাঙালির বৈষ্ণবধর্মের বিশেষত্বটি লক্ষণীয়। বিষ্ণুর মাধব নামের অর্থ হল মা অর্থাত্ জগন্মাতা লক্ষ্মীর সাথে বিরাজমান বিষ্ণু। প্রাচীনযুগ থেকেই বাঙালির চেতনায় তন্ত্রাশ্রিত বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব বর্তমান। বাঙালির মাতৃকা উপাসনা ধর্মের সাথে যুক্ত হয়ে বৈষ্ণব ধর্ম এক বিশালতা লাভ করেছিল। মাধব নামটি বৈষ্ণব ধর্মের মাতৃকা উপাসনা ধর্মের সাথে সেই সমন্বয়ের দ্যোতক। সেই মাধব বিগ্রহের উগ্ররূপই উগ্রমাধব। কাজেই উগ্রমাধব নৃসিংহের এক বিশেষ তন্ত্রাশ্রিত রূপ; এমনটা ভাবা যায়। বাঙালির সাধনদর্শনে ভয়াভয় অর্থাত্ যুগপৎ ভয়ঙ্কর অথচ ভয়হারী বিগ্রহের বিশেষ গুরুত্ব আছে।
পালযুগের অধিকাংশ মাতৃকা এই আপাত বৈপরীত্যের
ভাব বহন করেন। সেনযুগও তার ব্যতিক্রম নয়। সেনযুগে উমাপতিধর একাধিক স্তবে শক্তিসমেত বিষ্ণুর রূপবর্ণনা করেছেন। শৃঙ্গারনৃসিংহের স্তবে তিনি নৃসিংহদেবকে যুগপত্ রৌদ্র ও শৃঙ্গাররসের অনবদ্য
বিগ্রহরূপে ধ্যান করেছেন। উগ্রমাধব তাই একাধারে উগ্র নৃসিংহ ও মধুর মাধব;
এই দুইয়ের অপূর্ব সমন্বয়।
বৃহৎ বঙ্গের ভাগলপুরে প্রাপ্ত সেনযুগের নৃসিংহ মূর্তিকে
আমরা উগ্রমাধব বলে চিহ্নিত করতে পারি। নৃসিংহ শুধুই বিষ্ণুর রৌদ্র আবেশাবতার নন; তিনি তন্ত্রাশ্রিত বৈষ্ণবধর্মের চতুর্ভুজ মূর্তিকল্পও অঙ্গে ধারণ করেছেন। তাঁর হস্তের সুবিশাল চক্রায়ুধটিও তন্ত্রভাবনার নিবিড় সংযোগের ইঙ্গিত দেয়। আয়ুধসমূহের ক্রম অনুযায়ী ইনি ত্রিবিক্রম। ত্রিবিক্রমরূপে বিষ্ণু বিশ্বজগতের সাথে একীভূত। পরমা প্রকৃতির কাছে আশ্রয়লাভের ফলে পুরুষোত্তমের এই বিশালতায় উন্নীত
হওয়া মাধব রূপের ভাবনার সাথে অপূর্ব সাদৃশ্য বহন করে। এই মূর্তিটির পদযুগলের
মাঝের প্রলম্বিত অংশটি কোমরবন্ধনী হতে পারে; আবার ত্রিবিক্রমের তৃতীয়পদ হওয়াও অসম্ভব নয়। বিগ্রহের মুখে একইসঙ্গে ভক্তের প্রতি বাৎসল্যের মধুরতা ও রিপুদলনের উগ্রতা
বিদ্যমান।
সেনযুগের
মাধব বা উগ্রমাধব ছিলেন
তন্ত্রপরায়ণ বাঙালির সহজযান ও বৈষ্ণবতন্ত্রের মিলনে
উদ্ভূত সশক্তি নারায়ণের এমনই এক বিগ্রহ যা
একইসাথে ভক্তের হৃদয়ে মধুররস ও শত্রুর প্রতি
উগ্রভাবের উদ্রেক ঘটাত। উগ্রমাধবের মধ্যে সেনরাজারা তান্ত্রিক বাঙালির চিরকালীন শক্তিকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
রক্তিম মুখার্জি
Raktim Mukherjeeবাঙালির
ইতিহাস
0 comments: