বখতিয়ার খিলজীর পুরো নাম ”ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী” ।
মেজর রেভার্টি তবকাৎ-ই-নাসিরির অনুবাদ করার সময় বিন শব্দ ব্যবহার করা শুরু করেন । তিনি নাকি বারোটি পুঁথি দেখেছিলেন, তার মাঝে চারটিতে "বিন" পেয়েছিলেন। রেভার্টির আবার বিন-বাতিক ছিলো, তিনি আলি মর্দানকেও আলি বিন মর্দান লিখে গেছেন।
কারণ :
১. তবকাৎ-ই-নাসিরির সমসাময়িক গ্রন্থ তাজ-উল-মাসির এবং খানিক পরের গ্রন্থ ফুতুহ-উস-সালাতিনেও এনাকে ইখতিয়ারউদ্দিন (উপাধি) মুহম্মদ বখতিয়ার (নাম) খলজি বলা হয়েছে।
২.তুর্কি-পার্সিদের নামের মধ্যে বিন খুব একটা চলতি কিছু ছিলো না। তৎকালীন আর কোনো তুর্কি শাসকের নামের মধ্যে কি বিন পাওয়া যায়নি ।
৩. রেভার্টির অনুবাদের ধরণ ভুল ।
মেজর রেভার্টি'র অনুবাদ পড়ার সময় নিচের ফুটনোট যখন পড়বেন তখন সেখানে নাস্তালিকে লেখা মন্তব্য/উদ্ধৃতিগুলো পড়ার চেষ্টা করবেন। ভাষাটা জানা না থাকলে বিষয়টা একটু কঠিন, তবে একটু চেষ্টা করলে পড়তে পারবেন। তাহলে দেখতে পাবেন ফারসী বা আরবী যখন ইংলিশ হয়েছে তখন কত পালটে গেছে। আমি এই পদ্ধতি অনুসরণের চেষ্টা করি।
ভারতবর্ষের ইতিহাসের পুরনো বইগুলো সরাসরি ফারসী/আরবী থেকে বাংলায় অনুবাদের ব্যবস্থা করা উচিত। এই কাজটা বাংলা একাডেমি বা এশিয়াটিক সোসাইটি বহু কাল আগেই করতে পারতো।
৪. পার্সীরা বা ইরানীরা নামের মাঝখানে 'বিন' বা 'ইবনে' ব্যবহার করে না। তুর্কীস্তানীদের (তুর্কী নয়) মধ্যে এর ব্যবহার খুব অল্প, তুর্কীদের মধ্যে আরও কম।
মহম্মদ বিন তুঘলক অথবা ফিরোয বিন রজক'রা তুর্কীস্তানী, তুর্কী নয়।
ইখতিয়ার ছাড়া ভারতের তুর্কী শাসক কারা? কোন্ বংশ?
৫. তবকাৎ-ই-নাসিরির অনুবাদ বাংলা একাডেমি থেকে বেরিয়েছে, আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার করা। তবে সেখানে তিনি বেশ কিছু ভুল অনুসিদ্ধান্তও যোগ করেছেন; যেমন তাঁর মতে বখতিয়ারের জয় করা নওদীয়াহ নদীয়া নয়, বরং উত্তরবঙ্গের নওদা।
জনাব
যাকারিয়া এটি
কি
মূল
ফারসী
থেকেই
অনুবাদ
অনুবাদ
করেছেন,
তবে
ভূমিকায় তিনি
যা
বলেছেন,
তাতে
হতাশ
হতে
পারেন।
ভূমিকায় তিনি
বলেছেন-
"ফারসী
ভাষায়
আমার
জ্ঞান
অত্যন্ত সীমাবদ্ধ" এবং "ইতিহাসেও আমার
জ্ঞান
অত্যন্ত সীমিত"। হয়ত বিনয়
করেই
বলেছেন,
যাই
হোক।
ইখতি-বখতি নাম প্রসঙ্গে তিনি
পাদটীকায় কী
বলেছেন
তা
নিজেই
দেখুন।
আবদুল্লাহ্ ভাই, খেয়াল করে দেখুন এখানে ফারসী ভাষা আর তার বাংলা উচ্চারণ যা দেয়া আছে তাতে ছোট ছোট এদিক ওদিক তো আছেই সাথে শব্দ বাদ দিয়ে যাওয়াও আছে। আর মূল ফারসী থেকেই যদি অনুবাদ হয়ে থাকে তাহলে পদে পদে মেজর সাহেবের দোহাই টানা হয়েছে কেন?
সেই আমলে একটা অপেক্ষাকৃত কম সুলভ মূল গ্রন্থ ফার্সি থেকে অনুবাদ করার ক্ষেত্রে মোটামুটি স্বীকৃত একটা ইংরেজি অনুবাদের দোহাই টানা কি অপ্রাসঙ্গিক?
ছোটখাটো এদিক ওদিক বা শব্দ ছুটে যাওয়া যা এখানে আছে সেটা অর্থোদ্ধারে গুরুতর সমস্যা করছে না। তবে এমনটা চোখে পড়লে পাঠকের আস্থা কমে যায়।
সেই আমল মানে কোন আমল? আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া সাহেবকৃত তাবাকাৎ-ই-নাসিরী'র বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৩ সালে। মূল গ্রন্থ (ফারসী) তখন দুর্লভ ছিল না। তাছাড়া দুনিয়ার সেরা গ্রন্থাগারগুলোর অনেকগুলোতে উনার অ্যাক্সেস ছিল। উনি নিজে ভালো ফরাসী আর আরবী জানতেন। নিজের অনুবাদের শুদ্ধতা যাচাইয়ের জন্য উনি তাবাকাতের ইংরেজী, ফরাসী, আরবী, উর্দ্দু অনুবাদের সাথে যাচাই করে নিতে পারতেন, হয়তো তা করেছেনও। কিন্তু নিজের লেখায় পদে পদে মেজর সাহেবের দোহাই টানলে অনুবাদে পাঠকের আস্থা কমে যায়।
"মওলানা আবদুল হাই হাবিবী সম্পাদিত মূল ফারসী গ্রন্থটি এদেশে দুষ্প্রাপ্ত। ডক্টর আবদুল গফুর কাবুল থেকে গ্রন্থটি (দুই খণ্ড) যদি আনিয়ে আমাকে না দিতেন, তবে এ গ্রন্থের অনুবাদ আমার পক্ষে সম্ভব হত কিনা সন্দেহ"।
আর রেভারটি সাহেব ১২টি পাণ্ডুলিপির ভিত্তিতে অনুবাদ করেছিলেন, সেইসাথে বিপুল টীকাটিপ্পনি তো আছেই। ফলে যাকারিয়া সেই পাঠকেও সমুচিত গুরুত্ব দিয়েছেন। যাকারিয়া সাহেব অনুবাদ করতে গিয়ে ঠিক পূর্ণাঙ্গ পাঠ সমালোচনা বা টেক্সচুয়াল ক্রিটিসিজম করার মতো প্রস্তুতি হয়তো রাখতেন না। অবশ্যই এটা বিশ্বমানের বিদ্যাচর্চার জায়গা থেকে দৃষ্টিকটু বা অর্বাচীন ঠেকতে পারে, কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় আমার মতে সঙ্গত বলতে হবে।
৬. সুলতানদের নামের মধ্যে তো বাবার নাম না থাকাই অস্বাভাবিক, কারণ দুই একটা একসিডেন্ট বাদ দিলে বাবার ছেলে হওয়াই সুলতান হওয়ার প্রধান যোগ্যতা। সুলতান দিয়া সব মাপা কি ঠিক? আম আদমীর নামের মধ্যে যে বিন কম থাকত, ইহা বুঝা যায় বখতিয়ার খিলজীর সঙ্গে যে খিলজীরা বাংলায় আসছিল, তাদের নামে। আলী মর্দান, মোহাম্মদ শিরান, গিয়াসুদ্দিন ইওয়াজ, কারুর নামের মধ্যেই তো বিন নাই। সম্ভবত এই কারনে যে উহারা ছোট ঘরের পোলা। উহারা সুলতানের ঘরের পোলা হইলে হয়ত চোদ্দটা বিন লাগাইয়া পরদাদার গুষ্ঠী জাহির করত।
তুর্কিরা হল আনাতোলিয়ার তুর্কীভাষী বাসিন্দা। আর তুর্কিস্তানী হল মধ্য এশিয়ার তুর্কিক জনগোষ্ঠী, যারা বর্তমানে তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, এবং জিঞ্জিয়াং (চীন) অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। আফগানিস্তান, রাশিয়া, এবং মঙ্গোলিয়াতেও কিছু তুর্কিক বাস করে।
ইখতিয়ার তুর্কী এটা খুব নিশ্চিত তথ্য না। বরং 'খিলজী' গোত্রের বেশিরভাগ মানুষ তুর্কীস্তানী। সুতরাং গরমশিরের খিলজীরা তুর্কী নাকি তুর্কীস্তানী এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন।
সামানীরা পারসী। তাদের সুলতানদের নামের মাঝখানের 'বিন' বা 'ইবনে' মূলত আরবীভাষী ঐতিহাসিকদের কৃতিত্ব।
৭. ফারসীভাষী ঐতিহাসিকরাও তখন কলোনিয়াল চশমা পড়ে 'বিন' বা 'ইবনে' লিখে গেছেন। পারসীদের নামে 'বিন' বা 'ইবনে' না থাকার মূল কারণ এই শব্দ দুটো আরবী, ফারসী নয়।
ঘোরীরা তাজিক নাকি খাঁটি পারসী সেটা নিশ্চিত না। এদের নামে 'বিন' বা 'ইবনে' থাকার ব্যাখ্যা পূর্বরূপ।
খোয়ারেজমীরা আসলে পারসী সাম্রাজ্যে বসবাসকারী নন্-রেসিডেন্ট তুর্কীস্তানী। এদের ওপর থেকে আরবদের প্রভাব যত কমেছে এদের নামে 'বিন' বা 'ইবনে' ইত্যাদির ব্যবহার তত কমেছে। শুধু তাই না এক সময় এরা আরবী পদবী খলিফা/সুলতান/আমীর বলার বদলে ফারসী পদবী 'শাহ্' ব্যবহার করা শুরু করেছে।
গজনভীরা খোয়ারেজমীদের মতো পারসী সাম্রাজ্যে বসবাসকারী নন্-রেসিডেন্ট তুর্কীস্তানী। এদের নামে 'বিন' বা 'ইবনে' নাই। এদের প্রচলিত নামগুলো পুরনো পারসী সম্রাটদের মতো এক শব্দের (যথা, সবুক্তগীন, ইসমাইল, ইব্রাহিম, মাহমুদ, তুঘরুল ইত্যাদি)। এরাও নিজেদেরকে আরবী পদবী খলিফা/সুলতান/আমীর বলার বদলে ফারসী পদবী 'শাহ্' ব্যবহার করতো।
৮.সামানি সুলতানদের মুদ্রায় নামে
যে
"বিন"
থাকত
সেটা
কি
আরবিভাষী ঐতিহাসিক বা
তাঁদের
ফার্সিভাষী সাগরেদরা বসাতেন?
মূল
কথা
ঐ
"আরবি
প্রভাব"
বাড়া
কমা।
যতদিন
রাজকীয়
পরিচয়
নির্মাণে আরবি
প্রভাব
বেশি
ছিল,
ততদিন
"বিন"
মোটামুটি বহাল
তবিয়তে
ছিল।
অর্থাৎ
রাজার
জাতিগত
পরিচয়ের চেয়েও
অনেকাংশে বিরাজমান রাজকীয়
সংস্কৃতির স্বরূপ
ছিল
মূল
বিষয়।
তো বটেই। কিন্তু রাজপুরুষ "পার্সি" বা "তুর্কি" বলে রাজকীয় নামে "বিন" থাকবে না এটা খোঁড়া যুক্তি।
sachalayatan com/hrrh69/56694
0 comments: